কুষ্টিয়া প্রতিনিধি:-
স্বাস্থ্য সেবা নাগরিক জীবনে সাংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার হওয়া সত্ত্বেও স্পর্শকাতর এখাতটি এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসাধু মুনাফাখোর দূর্বৃত্তচক্রের দখলে। এতে প্রতি নিয়ত ঘটে চলেছে প্রাণহাণীর মতো অসংখ্য ঘটনা। দায়িত্ব নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। নানা সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সরকারী স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলি জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ভুমিকা রেখে যাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক অনুমোদন প্রাপ্তি থেকে শুরু করে নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার অভিন্ন অভিযোগ প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলির বিরুদ্ধে। এমনকি আবশ্যক প্রতিপালনযোগ্য বিধি লঙ্ঘনসহ চরম স্বেচ্ছাচারিতায় জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে কেবলমাত্র মুনাফা আয়ের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে জেলার প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলি। চিকিৎসার নামে জীবনহানির নিত্যদিনের ঘটনা হলেও এর দৃষ্টান্ত মূলক প্রতিকারের অনুপাত হাজারেও একটি মেলা ভার। তবে এমন হাজারও ঘটনার মধ্যে কুষ্টিয়ার এক চালকল শ্রমিকের প্রসুতি স্ত্রীর সিজারিয়ান চিকিৎসায় অবহেলা জনিত কারনে মৃত্যুর প্রাথমিক সত্যতা নিশ্চিত করে আদালতে অভিযোগ পত্র দাখিল করেছে কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশ; এভাবেই বলছিলেন কুষ্টিয়ার সরকারী কৌশুলী এ্যাড. অনুপ কুমার নন্দী। ছোট্ট বাবু তাওহীদ(৭মাস)। ওর জন্মই যেন আজন্ম পাপ হয়ে মা হারা শিশুটির ঠাঁই হয়েছে নানা আরশেদ আলী ও নানী পারুল বেগমের ঘরে। জন্মের পর থেকেই কোলে পিঠে করে লালন-পালন করছেন তারা। চিকিৎসক ও ক্লিনিক মালিকের প্রতারনা ও অবহেলা জনিত প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনা নিছক নতুন কিছু নয়। তবে এক্ষেত্রে পরিবারের অনড় অবস্থার কারনে কুমারখালী উপজেলার বাঁশগ্রাম গ্রামের বাসিন্দা ও চালকল শ্রমিক আলী আকবরের প্রসুতি স্ত্রী তানিয়া খাতুন(২২)র মৃত্যুর ঘটনায় নিহতের স্বামী আলী আকবর বাদি হয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানায় করা মামলায় বিচারের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য সহকারী, দালালসহ ক্লিনিক মালিক। অবহেলা জনিত মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত ও এজাহার নামীয় আসামী চিকিৎসক ডাঃ আবু সাঈদ সিদ্দিকী(৬০),নার্স পাপিয়া খাতুন ওরফে সুকু(৪৭), স্বাস্থ্য সহকারী রাকিবুল ইসলাম ওরফে রফিকুল ওরফে নয়ন(৩৭), ক্লিনিক মালিক মশিউর রহমান নিজাম(৫৫) এবং দালাল মিরপুর উপজেলার তাঁতিবন্ধ গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে রেজাউল(৪৮)সহ মোট ৫জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেছেন কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশ। আদালত সূত্রে জানা যায়,২০২০ সালের ০১আগস্ট বিকেলে কুমারখালী উপজেলার বাঁশগ্রামের বাসিন্দা চালকল শ্রমিক আকবর আলীর সন্তান সম্ভবা প্রসুতি স্ত্রী তানিয়া খাতুন(২২)র প্রসব ব্যাথা উঠে। পরিবারের লোকজন প্রসুতি তানিয়াকে দ্রুত কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে আসে। পথের মধ্যে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদ রোডে স্থানীয় ইসলামীয়া হাসপাতাল নামের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকের দালাল রেজাউলের সাথে দেখা হয়, এসময় রেজাউল প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নানা সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে রোগীর যানবাহনটির গতিরোধ করে ওই প্রাইভেট ক্লিনিকে প্রবেশ করায়। এসময় সেখানে ক্লিনিক মালিক, চিকিৎসক ও নার্স তড়িঘড়ি কোন প্রকার উপযুক্ততা বা সম্ভাব্যতা যাচায় ব্যতিরেকে প্রকৃত শৈল্যচিকিৎসক ও এনেসথেসিওলজিষ্ট ছাড়াই দ্রুত সিজার করে তানিয়ার গর্ভ থেকে একটি পূত্র সন্তান প্রসব করাতে পারলেও জ্ঞানশুন্য মা তানিয়ার জ্ঞান আর ফেরাতে পারেনি। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ওই ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে রোগিকে বের করে দেন এবং উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দেন। পরে রোগীর সঙ্গীয় স্বজনরা রোগীকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রসুতি মা তানিয়াকে মৃত: ঘোষন করেন। এঘটনায় রোগীর স্বামী আকবর আলী সংক্ষুব্ধ হয়ে চিকিৎসা অবহেলার কারনে মৃত্যু যা হত্যাকান্ডের সামিল এমন অভিযোগে মামলা করেন কুষ্টিয়া মডেল থানায়। মামলাটি তদন্ত শেষে এজাহার নামীয় চিকিৎসক ক্লিনিক মালিকসহ ৫আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের পাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ৫আসামীর বিরুদ্ধে আদালতে গত বছরের নভেম্বরে অভিযোগ পত্র দাখিল করেন পুলিশ। কিন্তু নানা প্রতিকুলতার নিরসন করে অবশেষে গত সপ্তাহে আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জ শুনানী দিন ধার্য করেছেন আদালত। প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা অবহেলায় রোগী মৃত্যুর ঘটনায় ময়না তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনা পূর্বক মন্তব্য জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা: তাপস কুমার সরকার বলেন, প্রাইভেট ক্লিনিকে অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনার সাথে পারিপাশির্^ক অনেক বিষয় সংশ্লিষ্ট থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় কর্তৃক প্রনীত বিধিমালা লঙ্ঘিত হয়েছে কিনা সেগুলি নিবির ভাবে পর্যবেক্ষন করলেই বোঝা যায় যে সেখানে চিকিৎসা ত্রুটি বা অবহেলা ছিলো কি না যে কারণে রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে। মৃত: তানিয়া খাতুন(২২)র ময়না তদন্তের চুড়ান্ত মতামতে: “ঞযব পধঁংি ড়ভ ফবধঃয রং ফঁব ঃড় ংঁফফবহ পধৎফরধপ ধৎৎবংঃ যিরপয রং ধহঃব-সড়ৎঃবস ধহফ ধপপরফবহঃধষ রহ হধঃঁৎব. তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনার পারিপাশির্^ক বাস্তবতায় চিকিৎসা অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর সত্যতা পেয়েছেন বলে তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন বলেন, বে-সরকারী ক্লিনিক বা ডায়াগোনষ্টিক সেন্টার বা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিধি মতে, অপারেশন থিয়েটার পরিচালনার সময় প্রাসঙ্গিক চিকিৎসকের পাশাপাশি এ্যানেসথেসিয়া এক্সপার্ট থাকা আবশ্যক। অন্যথায় কোন ভাবেই ওটি চালাতে পারবেন না। অভিযুক্ত প্রাইভেট ক্লিনিক ইসলামী হাসপাতালে বিধিমতে নির্ধারিত শর্ত পালনের ব্যাত্যয় লক্ষ্য করা গেছে। তাছাড়া তাদের লাইসেন্সের বিষয়েও কিছু নিয়মের ব্যাত্যয় আছে। মামলা যেখানে হয়েছে, এখন বিষয়টি একান্তই আদালতের ব্যাপার। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ হিসেবে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলি নানাবিধ এসব অনিয়মের দায় সিভিল সার্জন এড়াতে পারেন কি না এমন প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন সিভিল সার্জন এএইচ এম ডা: আনোয়ারুল ইসলাম।
চিকিৎসা অবহেলা জনিত মৃত্যুর ঘটনায় ইতোপূর্বে আরও অসংখ্য ক্ষতিগ্রস্ত বা ভুক্তভোগীর স্বজনদের দেয়া অভিযোগের সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর সকাল ৯টায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার আল্লার দর্গা বাজারের বিশ্বাস ক্লিনিকে ভূল সিজার অপারেশনে প্রসূতি রমনী খাতুন(২০)সহ গর্ভজাত শিশুটিরও মৃত্যু হয়। হোগলবাড়ীয়া ইউনিয়নের বাচ্চু আলীর স্ত্রী রমনী খাতুন কে অতিরিক্ত এনেস্থিসিয়া প্রয়োগের ফলে মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়। সে সময় ডাঃ টিএ কামালসহ ক্লিনিক মালিকের অবহেলা জনিত হত্যার অভিযোগ ওঠে।
২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার কুমারখালি উপজেলার সোন্দহ গ্রামের শাপলা খাতুন (২২) কুষ্টিয়া শহরের কাস্টমস মোড়ের শাপলা ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে সিজার অপারেশনের মাধ্যমে পুত্র সন্তান লাভ করার কয়েক ঘন্টার মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে প্রসুতি মা। সে সময় অপারেশন জনিত সমস্যা ও রোগীর শরীরে ভূল রক্ত সঞ্চালনের অভিযোগ ওঠে।২০২০ সালের ৯ মার্চ দুপুর ২টায় কুষ্টিয়া শহরের পেয়ারাতলায় পদ্মা প্রাইভেট হাসপাতালে ভূল সিজার অপারেশনে নব জাতক পুত্র সন্তান রেখে প্রসূতি ফাতেমা খাতুন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সে কুমারখালী উপজেলার সাওতা গ্রামের আব্দুর রশিদের স্ত্রী। এ ঘটনায় ক্লিনিক মালিক দেলোয়ার ও মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট নান্নুর বিরুদ্ধে সিজার অপারেশনে অংশগ্রহণের গুরুতর অভিযোগ ওঠে। ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সাহাদালী ক্লিনিকে ভূল সিজার অপারেশনে ইভা খাতুন(১৯) নামের এক প্রসূতি নবজাতক সন্তান রেখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। সে মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামের নান্টু মিয়ার স্ত্রী। পারভেজ নামের এক ভূয়া চিকিৎসক অপারেশনটি পরিচালনা করে।